Sunday, 19 August 2012

সিঁড়ি


গুনে গুনে ২০টা ধাপ ভাঙলে তবে ছাদ। চারপাশের ইঁটের জঙ্গলের মাঝে ছোট্ট একটা দোতলার ছাদসে ছাদের কোনো বাহার নেই, কাপড় শোকানোর জন্য ছাড়া বড় একটা কেউ সেখানে যায়ও না। যান শুধু কাবেরী। ঠিক ছাদে নয়, ছাদের কোনায় যে একটা ঠাকুরঘরটা - সেইখানে

ঠাকুরঘরের ভেতরেও বিশেষ কিছু নেই – খালি একটা মাঝারি আয়তনের সিংহাসন আর তার ওপর শালগ্রামশিলা, মা কালীর ফটো, গণেশের মূর্তি, শিবলিঙ্গ। কিন্তু সে সব ছাপিয়ে যেটা সবচেয়ে বেশী চোখে পড়ে সেটা হল উত্তরের দেওয়ালে পাশাপাশি তিনটে ক্যালেনডার। একটায় সারদা মা, একটায় রাধা-কৃষ্ণ, আর একটা মা তারার ছবি। নীচের তারিখগুলোর বিশেষ কদর নেই অবশ্যতারিখ আর ক্ষণের শুভাশুভের হিসেব রাখতে পাঁজি তো রয়েছেই। ক্যালেন্ডারগুলোর আসল ব্যবহার হল নিয়ম করে ছবির মা তারার পায়ে আর সারদা মায়ের কপালে লাল চন্দনের ফোঁটা দেওয়া। রাধা-কৃষ্ণর জন্য যদিও শ্বেতচন্দনের ব্যবস্থা। এই নিয়মের অন্যথা হয়নি গত ৭ বছরে। আজও হওয়ার কোনো কারণ নেই।

তবে বাধ সাধছে ওই ২০ ধাপ সিঁড়ি। ঠিক আজ নয়, গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই বাধ সাধছে।

প্রথম কয়েক ধাপে কিন্তু এখনো বিশেষ কষ্ট হয় না।

রেলিঙে ভর দিয়ে তরতর করে ৫টা ধাপ উঠে পড়লেন কাবেরীদেবী। একটু দম নিলেন।

সিঁড়ির মাঝামাঝি থেকে এক পাশ ধরে চটি সাজানো – কোনোটা ঘরের, কোনোটা বাইরের। নজর পড়তেই মেজাজটা খিঁচড়ে গেল। বড্ড, বড্ড বিরক্ত লাগে ওনার এটা দেখলেইকতদিন বলেছেন, একটা জুতোর র‍্যাক কিনলেই চুকে যায়। বুবাই নির্ঘাত একদিন পা জড়িয়ে পড়ে অনর্থ ঘটাবে।

বুবাই - মানে সবেধননীলমণি নাতি। যার চিন্তা করতে করতে আজকাল মন্ত্রের খেই হারিয়ে ফেলেন কাবেরী – সেই বুবাই।

আজ ফিরুক ছেলে, ঘ্যান ঘ্যান করে করে ব্যাতিব্যস্ত করে তুলবেন, যতক্ষণ না রাজি হয়। সে ফিরতে যত রাতই হোক। মনে মনে রাত ৯টার ঘরে একটা ঢ্যাঁড়া দিলেন কাবেরী।

ছেলে বউ নাতি নিয়ে কাবেরীর ছোট্ট সংসার। ছোট বলে কিন্তু ঝক্কি কম না। যাবতীয় দায় দায়িত্ব বউমার হাতে ছেড়ে দিয়েছেন, তবু তার সংসার থেকে ছুটি পাওয়া হয়নি এখনো। নাতির পেট কামড়ালে দেশোয়ালি টোটকা দেওয়া থেকে শুরু করে পুজোয় ছেলের শ্বশুরবাড়ির জন্য শাড়ি পছন্দ করা অবধি, সবটাতেই এখনো তার নজরের প্রয়োজন পড়ে। অনেকদিন থেকেই ভাবছেন, এবার ছুটি নেবেন। সত্যিই তো, আর কতদিনই বা টানবেন? আজ ৪০ বছর হতে চলল, এই জোয়াল কাঁধে নিয়েছেন, এবার তো...

ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল, পুজোর আর মাত্র এক মাস বাকি, কিন্তু শাড়ি এখনো কেনা হয়নি। উফ্‌ফ্‌, সব কী এখনো ওনাকেই মাথায় রাখতে হবে? সিঁড়ির মত বিরক্তিও আজ ধাপে ধাপে উঠছে।

রাত ৯টার ঘরে আর একটা ঢ্যাঁড়া পড়ল।

লম্বা একটা নিশ্বাস টেনে পরের ধাপটা উঠলেন কাবেরী। আর অমনি মাথায় কি একটা ঠেকলো।

ন্যাতা! সিঁড়ির এপার-ওপার টানা দেওয়া কাপড় শুকোনোর দড়ি, তার ঠিক মাঝখানটায় ঝুলছে একটা নোংরা ন্যাতা। কোনো মানে হয়? এই চান করে বেরোলেন, পুজো দেবেন। ছিঃ! আর সহ্য করা যাচ্ছে না!

“বউমাআআআআ”!!

বউমার সাড়া তিনি আশা করেননি এই সময়। তার তো রোজ রাত জেগে খুটখাট ল্যাপটপে কাজ, আর রোজ দেরী করে ওঠা। এখনো তার ঘুমের সময়।

ডাকে যদি সাড়া নাও দেয়, অন্তত ঘুমটা ত নষ্ট হবে একটু। বুড়ো মানুষটাকে ভোগানোর এইটুকু শাস্তি অন্তত হোক!

“বউমাআআআআ”! গলাটা একটু চড়িয়ে চেঁচালেন কাবেরী।

সাড়া নেই। না থাক। তিনি নিশ্চিত ঘুম এবার ঠিকই ভেঙেছে। বিরক্তির পারদ একটু নামিয়ে পরের সিড়ির ধাপে মন দিলেন কাবেরী। ঠাকুরঘরে গঙ্গাজল তো আছেই, শুদ্ধি করে নেওয়া যাবেখন।

২০ ধাপ সিড়ি – ১০টা এমুখো, ১০টা ওমুখো। মাঝখানে একটা ছোট্ট ল্যান্ডিং। ছেলে একটা টুল রেখে দিয়েছে ওখানে। কাবেরী ওইখানে বসে একটু জিরিয়ে নেবেন।

কিন্তু তার আগে আরও ৪টে ধাপ।

অনেকদিন ধরেই ছেলে বলে আসছে - ঠাকুরকে একতলায় নামিয়ে আনলেই হয়, রোজ রোজ এইভাবে সিড়ি ভাঙার তো কোনো প্রয়োজন নেই! ও কি বুঝবে? আজকালকার মেয়ে – তাদের হাতে সংসার ছাড়া যায়। কিন্তু পুজো, ছোঁওয়াছুঁই? ও কি ওদের বোঝানো যায় নাকি? বেশী বলতে গেলেও আবার কথা শোনাবে – কোনটা কুসংস্কার, কোনটা পাগলামি – আরও কত কি!

তার চেয়ে ভাই ন্যাতার ওপর দিয়েই যাক!

নিজের মনে বিড়বিড় করছিলেন কাবেরী। কখন যে টুলটায় পৌঁছে গেছেন, খেয়াল করেননি। ডান হাঁটুটা শক্ত করে চেপে ধরে আস্তে আস্তে বসলেন, কপালের ঘাম মুছলেন আঁচলে।

পুজো আসতে চলল। মা-কে সোনার হার দেবেন বলে মানত করা আছে। কি করে দেবেন কে জানে? এই হাঁটুর ব্যথায় বেরোনই দায়। সেই শেষ কবে দক্ষিণেশ্বর গেছিলেন, উনি বেঁচে ছিলেন তখনও। সেবারই মানত করেছিলান, বউমার ছেলে হলে সোনার হার দেবেন। সেই শীতেই বুবাই হল, আর তার পর পরেই উনি চলে গেলেন। তারপর থেকেই বাড়ির বাইরে বেরোনো বন্ধ হয়ে গেছে।

এই পুজোয় একবার মাকে দেখার ইচ্ছে আছে। তারপর তিনি নিশ্চিন্তে মরবেন।

দেখি। এটাও তো সেই ছেলেকে বলতে হবে।

আর কতো কীই বা উনি বলবেন ছেলেকে? আজকাল ওনার বক্‌বক্‌ শুনতে শুনতে ছেলেও বিরক্ত হয়ে গেছে। উনি যাই বলেন, চুপচাপ শুনে কেমন নির্লিপ্ত মুখে “আচ্ছা” বলে চলে যায়।

“তখন কিছু বলছিলে, মা?” বউমার গলা পেয়ে চিন্তায় ছেদ পড়ল কাবেরীর।

“না বউমা, এই কটা বাজে জিজ্ঞেস করছিলাম।”

“সাড়ে দশটা। তোমার পুজো হয়ে গেছে?”

“হ্যাঁ, এই তো, আর একটু বাকি” বলে মনে মনে জিভ কেটে উঠে পড়লেন কাবেরী। সত্যিই আজ দেরী হয়ে গেছে। এখনও ১০টা ধাপ বাকি যে!

উঠেই বসে পড়লেন। বুকটা ধড়ফড় করছে একটু। আজকাল মাঝেমাঝেই শ্বাসকষ্ট হয়।

আঁচলটা দিয়ে একটু হাওয়া খেলেন খানিক্ষণ। দরদর করে ঘাম আসছে। তবে এটা নতুন কিছু না। একটু চোখ বুজে বসে থাকলেই কমে যাবে।

বসে থাকতে থাকতেই গাছগুলোর কথা মনে পড়ল। ঠাকুরঘরের দরজার কাছে কয়েকটা টব বসিয়েছেন কাবেরী – তুলসি, বেলফুল, গাঁদা। কালই খেয়াল হল বেলগাছটার পাতাগুলো মরে যাচ্ছে – সার দিতে হত।

“ওই যাঃ! খুরপিটা আনা হল না তো!” মাটিটা একটু খুঁচিয়ে আলগা করে দেওয়ার দরকার ছিল।

“আর ক’টা জিনিস মাথায় রাখব? মা, মা গো!”

উঠে দু’ধাপ পেরোলেন কাবেরী। আরো ৮ ধাপ বাকি।

ভেজানো ছাদের দরজার ফাঁক দিয়ে এক চিলতে রোদ এসে পড়েছে শেষ ধাপটায়। সেদিকে তাকিয়ে কাবেরীর আপশোশ আর বেড়ে গেল। সকাল-টা মেঘলা দেখে ডালবাটাটা রান্নাঘরেই রেখে এলেন। এরম রোদ জানলে বড়ি শুকোতে দিয়ে দিতেন। বউমা বড্ড আরাম করে খায়।

ওকে বলি ডালবাটাটা দিয়ে যেতে?

“বউমাআআআআ”!

আগের দু বারের মতই সাড়া নেই।

যাক গে। কাল দেওয়া যাবেখ’ন।

হয়ে এসেছে। আর একটু উঠলেই শেষ। একটা লম্বা দম নিলেন কাবেরী।

আজ খুব ঘাম হচ্ছে।

********************************

“স্যার, বুড়িটা তো বক্‌বক্‌ করেই দিন কাবার করে দিল। লোক পাঠাই?”

“অত তাড়া কিসের হে চিত্রগুপ্ত? এ তো যে-সে জিনিস না, হল স্বর্গের সিঁড়ি - ভাঙতে সময় লাগে। তুমি বরং লাঞ্চটা সেরেই এসো।” বলে যমরাজ চোখ বুজলেন।